সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে মহিষের সেদ্ধ মাংস বিক্রির বাহারি বিজ্ঞাপন ঘুরছে। কেনা যাচ্ছে একেবারে পানির দরে! অনলাইনে চাহিদার কথা জানালে মাংস পৌঁছে যাচ্ছে রেস্তোরাঁর দুয়ারে কিংবা ক্রেতার ঘরে। লবণ-হলুদের মিশেলে সেদ্ধ এসব মহিষের মাংস কৌশলে পাশের দেশ ভারত থেকে আনছেন আমদানিকারকরা। হিমায়িত মাংস আমদানিতে কড়াকড়ি থাকলেও এটি দেশে ঢুকছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ঘোমটা পরে।
এ সেদ্ধ মাংস এমনই জাদুকরী, এক কেজি রান্না করলে ফুলেফেঁপে হয়ে যায় তিন কেজি। এ কারণে কেজি ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকায় নেওয়া হলেও আদতে দাম পড়ে মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। দেশের বাজারে এখন কাঁচা মহিষের মাংসের কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এ কারণে সারাদেশের রেস্তোরাঁ মালিকরা এই সেদ্ধ মাংস কিনতে হুমড়ি খাচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত মাংসে বেশি পরিমাণে লবণ এবং কিছু রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। এসব কারণে শরীরে নানা রোগব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
গরুর মাংস উদ্বৃত্ত থাকার পরও দেশে হিমায়িত মহিষের মাংস বৈধ-অবৈধ পথে আসছিল টনে টনে। স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রান্তিক খামারিদের কথা চিন্তা করে সরকার গত বছর থেকে হিমায়িত মাংস আমদানিতে কঠোর হয়। এখন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া মহিষের মাংস আমদানি করা যাচ্ছে না। আর অধিদপ্তর গত দেড় বছর কাউকে অনুমতিও দেয়নি। একটি চক্র নানা দৌড়ঝাঁপ করে ব্যর্থ হয়ে নতুন ফন্দি আঁটে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের নামে সেদ্ধ মহিষের মাংস প্যাকেট করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশে মাংসের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দামও। গরুর মাংস সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আর এ জন্য সংশ্লিষ্টরা দায়ী করেছেন সিন্ডিকেটকে। খামারি ও ব্যবসায়ীরা মাংসের দর নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানালেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ পরিস্থিতিতে দেশে ফের হিমায়িত মহিষের মাংস আমদানির পাঁয়তারা চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুর মাংস আমদানি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক খামারিরা। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়বে। এ জন্য যৌক্তিক দর নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
মাংস ফুলে ওঠে, লাভও বাম্পার
তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফেসবুকে মেলে কয়েকটি পেজ। তেমনই একটি ‘আমজাদ বাজার অনলাইন শপ’। মহিষের সেদ্ধ মাংসের একটি ভিডিও দিয়ে তারা লিখেছে, ‘সেদ্ধ করা মহিষের মাংস ঢাকা সিটিতে হোম ডেলিভারি এবং সারাদেশে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়।’ যোগাযোগের জন্য দেওয়া মোবাইল নম্বরে রেস্তোরাঁ মালিক পরিচয়ে ফোন দেওয়া হলে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের এজাজ আহমেদ বলেন, ‘ইন্ডিয়া থেকে মহিষের মাংস আগে কাঁচা আসত। এখন আর সেভাবে আনতে দিচ্ছে না। এ কারণে হাড় ছাড়া মহিষের মাংস ছোট ছোট টুকরো করে প্রথমে লবণ ও হলুদ মিশিয়ে সেদ্ধ করা হয়। পরে শুকিয়ে প্যাকেট করে এখানে পাঠানো হয়। গরম করার কারণে মাংসের ভেতরে রস পুরোপুরি বের হয়ে যায়। এক কেজি মাংস হোটেলে রান্না করলে তিন কেজির সমান হয়। আমাদের এখন পাঁচ টন মাংস মজুত আছে। যে হোটেল মালিক একবার এ মাংস নেন, অনেক লাভ হওয়ায় তিনি আর বাজারের কাঁচা মাংস কেনেন না।’
রাজধানীর নিউমার্কেটের হোটেল মালিক জাফরুল্লাহ বলেন, ‘প্যাকেট করা সেদ্ধ মাংস নিয়মিত অনলাইন থেকে কেনা হয়। রান্না করার পর এটা ফুলে ওঠে, লাভও বাম্পার।’
কারওয়ান বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী নাহিদ বলেন, ‘একসময় কাঁচা হিমায়িত মাংস কিনে রান্না করতাম। এখন সেই মাংস পাওয়া যায় না। কয়েক মাস ধরে সেদ্ধ মাংস কিনছি। কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় কিনছি। কেটে ছোট করে রান্না করার পর তিন কেজির মতো হয়ে যায়।’
আমজাদ বাজার অনলাইন শপের ফেসবুক পেজে আপলোড করা ভিডিওতে দেখা গেছে, অপরিচ্ছন্ন একটি কক্ষে থরে থরে সাজানো মাংসের প্যাকেট। সাদামাটা পলিথিনে রাখা মাংসের মেয়াদ লেখা ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি।
যে কারণে আমদানিতে কড়াকড়ি
আকস্মিক ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়। সেই থেকে দেশের কৃষক এবং খামারিদের গরু দিয়ে ঈদে কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে। গেল কোরবানির ঈদেই ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫২১টি পশু অবিক্রীত থেকেছে। এতে এখনও লোকসানের বোঝা টানছেন খামারিরা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফ) এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১২ লাখ খামার আছে এবং ৯৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ডিএলএসের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ সালে মাংস উৎপাদন ছিল প্রায় ৯ লাখ টন, পরে ২০২১-২২ সালে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯৩ লাখ টন। ১০ বছরে মাংস উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫৬ শতাংশ। ৭.৪ মিলিয়ন টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে ৮.৪৪ মিলিয়ন টন মাংস উৎপাদন হচ্ছে। ফলে গত বছর থেকে মাংস আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। শুধু তা-ই নয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মাংস রপ্তানির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
তবুও ভিন্ন কৌশল
আমদানি ঠেকাতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও ২০২২-২৩ সালে ৯৭৪ টন হাড় ছাড়া হিমায়িত বোভাইন মিট আমদানি হয় বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এসব পণ্যের আমদানি দর ৪৪ কোটি টাকা।
গত ১০ মে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়েই ভারত থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে এক টন হিমায়িত মহিষের মাংস দেশে আনে মেডলাইফ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি কোম্পানি। মাংস দিয়ে আচার বানিয়ে রপ্তানি করার ঘোষণা থাকলেও তাদের নেই কোনো কারখানা। পরে মাংসগুলো রাজধানীর একটি কোল্ডস্টোরেজে জব্দ করে রাখা হয়। দীর্ঘ ৮০ দিন পর গত ২ আগস্ট উচ্চ আদালতের নির্দেশে ওই মাংস বাজেয়াপ্ত করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচা মাংস আমদানি করতে না পেরে এখন প্রক্রিয়াজাত মাংসের প্যাকেট এনে রেস্তোরাঁয় বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকার অন্তত ১০টি হোটেল-রেস্তোরাঁয় অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, ছয়টিতেই ভারত থেকে আসা এই সেদ্ধ মাংস নিয়মিত রান্না হচ্ছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, সেদ্ধ মাংস আমদানি করা ছাড়াও চক্রটি আমদানির অনুমতি নিতে নিয়মিত দৌড়ঝাঁপ করছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সহায়তা ও পরামর্শ নিয়ে মাংস আমদানির অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে তদবির চলছে। আমদানিকারকরা বাজার অস্থিতিশীল করতেও তৎপর। এ লক্ষ্যে তারা মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতিকে দিয়ে মাংস আমদানির পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছে।
এমনকি বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ গত ২৫ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বিদেশ থেকে গরুর মাংস আমদানির পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে দেশীয় উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতে গরুর মাংস আমদানি করা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
এক মাংস আমদানিকারকের ফোনালাপের অডিও সমকালের হাতে এসেছে। সেখানে তিনি একজনকে বলছেন, ‘রান্না করা (সেদ্ধ) মাংস আমদানি আইনসম্মত। যতদিন মাংস আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে না, ততদিন সেদ্ধ মাংস বিক্রি করতে হবে। মাংস আমদানির অনুমতির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সহায়তা দিচ্ছেন। তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমদানিকারকদের একটি সনদ দিয়ে মাংস প্রবেশে বড় ভূমিকা রেখেছেন। এবার তিনি ডিজি হলে সব উন্মুক্ত করে দেবেন।’
এ ব্যাপারে ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সমকালকে বলেন, কাঁচা মাংস আনতে আমাদের অনুমতি লাগে। কোনো পণ্য সেদ্ধ করার পর তা খাদ্য হয়ে যায়। তখন আর আমাদের কিছু বলার থাকে না। মাংস আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, দাম বেশি থাকলে আমদানি, আবার দাম কমলে আমদানি বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। যখন দাম বেশি থাকে, তখন উদ্বৃত্ত থাকার পরও চাল, পেঁয়াজ, রসুনের মতো পণ্য আমদানি হচ্ছে। এতে ভোক্তা উপকৃত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ মিট ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমআইটিএ) সভাপতি শামীম আহম্মেদ বলেন, ‘গত বছরের এপ্রিল থেকে মাংস আমদানি একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের ব্যবসা বন্ধ। একসময় কেজি ১৫০ টাকা দরে আমরা মাংস দিতে পারতাম। ফ্রোজেন মিট কেনেন প্রান্তিক শ্রেণির ক্রেতারা। এ ছাড়া বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় ফ্রোজেন মিট ভালো চলে। এখন আমদানি বন্ধ থাকার ফলে দাম যেমন বাড়ছে, আবার দেশের পুষ্টি নিরাপত্তাও হুমকিতে পড়েছে।’
গ্লোবাল প্রডাক্ট প্রাইজ নামে একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, দাম বাড়ার দিক থেকে ৭৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। দেশের বাজারে গরুর মাংসের সংকট নেই। তবে গত এক বছরে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া সার্বিক উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও বেশি মাংস উৎপাদনকারী উন্নত প্রজাতির গরু না থাকায় বাজারে মাংসের দাম কমছে না। তবু আমাদের খামারিরা গত জুলাই থেকে বাজারের চেয়ে ৫০ টাকা কমে মাংস বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে মাংসের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রক্রিয়াজাত মাংসে বেশি পরিমাণ লবণ এবং রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে এসব খেলে নানা রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, গবাদি পশু উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশ থেকে মাংস আমদানি করলে পুরো খাত বিপদে পড়বে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম বলেন, খাদ্যপণ্য নিরাপদ কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। আমরা মহিষের সেদ্ধ মাংসও পরীক্ষা করব। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করতে চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, মহিষের সেদ্ধ মাংস নিরাপদ কিনা তা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার পর আমরা অভিযানে নামব।
এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, গরুর মাংসের দাম বাড়ার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনা দায়ী। সারাবছর চাহিদা মেটানোর পরও গরু উদ্বৃত্ত থাকছে। এ কারণে এখন মাংস রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি দেশের খামার সম্প্রসারণে নানা সুবিধা দিচ্ছে। মাংস আমদানি করার মতো পরিস্থিতি এখন আর দেশে নেই। সুত্র: সমকাল
পাঠকের মতামত